অতিরিক্ত ঘাম ও ঘামে দুর্গন্ধ? কারণ, ঘরোয়া সমাধান ও আধুনিক চিকিৎসা
অতিরিক্ত ঘাম ও ঘামে দুর্গন্ধ? কারণ, ঘরোয়া সমাধান ও আধুনিক চিকিৎসা
আমাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ঘাম হওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে, অনেকের জন্য অতিরিক্ত ঘাম একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারও কারও ঘামে দুর্গন্ধ দেখা যায়, তখন ব্যাপারটি আরও বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা অতিরিক্ত ঘাম ও ঘামে দুর্গন্ধ হওয়ার কারণ ও প্রতিকার, ঘরোয়া সমাধান এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো।
ঘাম কেন হয়?
ঘাম হওয়া আমাদের শরীরের একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এটি সাধারণত আমাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আমাদের শরীর অতিরিক্ত তাপ থেকে বাঁচার জন্য ঘামের মাধ্যমে তাপ নির্গমন করে। যখন আমাদের শরীর গরম হয়, তখন ঘাম বের হয় এবং এটি বাষ্প হয়ে ত্বক থেকে তাপ দূর করে। মানসিক চাপ, শরীরচর্চা, গরম আবহাওয়া, মশলাযুক্ত খাবার খাওয়া ইত্যাদি কারণেও ঘাম হতে পারে। এছাড়াও, শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করতেও ঘাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ঘাম হওয়ার উপকারিতা
১. শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ:ঘাম শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
২. ডিটক্সিফিকেশন:ঘামের মাধ্যমে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের হয়।
৩. ত্বক পরিস্কার:ঘামের মাধ্যমে ত্বকের রন্ধ্র খুলে যায়, ফলে ত্বক পরিস্কার থাকে।
অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণ
হাইপারহাইড্রোসিস (Hyperhidrosis)
এটি এমন একটি অবস্থায় যেখানে শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘাম তৈরি করে। এটি একজন ব্যক্তির শরীরের নির্দিষ্ট অংশে বা সারা শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হয়। এটি সাধারণত দুই ধরনের হয়:
প্রাথমিক হাইপারহাইড্রোসিস: এর কোনও নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। সাধারণত এটি বংশগত হতে পারে এবং এটি প্রধানত হাত, পা, মুখ ও বগলের মতো স্থানে বেশি লক্ষ্য করা যায়।
দ্বিতীয় হাইপারহাইড্রোসিস: এটি হয় কোনও নির্দিষ্ট রোগ বা শারীরিক সমস্যার কারণে, যেমন ডায়বেটিস, থাইরয়েড সমস্যা, সংক্রমণ, অথবা কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
মানসিক চাপ
উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, এবং স্ট্রেস অতিরিক্ত ঘামের কারণ হতে পারে।
হরমোনাল পরিবর্তন
হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে ঘাম হওয়া একটি সাধারণ বিষয়। হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ঘাম হওয়ার কয়েকটি সাধারণ কারণ হল:
১. মেনোপজ: মেনোপজের সময় ইস্ট্রোজেন হরমোনের স্তর কমে যায়, যা হট ফ্ল্যাশ এবং নাইট সুইটের কারণ হতে পারে।
২. গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থার সময় হরমোনের পরিবর্তনের ফলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং ঘাম বাড়তে পারে।
৩.বয়ঃসন্ধি : কৈশোরে হরমোনের তারতম্যের ফলে ঘামগ্রন্থি বেশি সক্রিয় হতে পারে। তখন শরীরে ঘামও বেশি হতে পারে।
৪. থাইরয়েড সমস্যা: হাইপারথাইরয়েডিজম (Hyperthyroidism) হলে ঘাম বেশি হয়। এই অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন করে, যার ফলে শরীরের মেটাবলিজম বেড়ে যায় এবং শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে, ফলে অতিরিক্ত ঘাম হয়।
৫. স্ট্রেস এবং মানসিক চাপ: স্ট্রেস এবং মানসিক চাপের সময় ঘাম বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হল শরীরের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া। যখন আমরা স্ট্রেস বা মানসিক চাপের মধ্যে থাকি, আমাদের শরীর "ফাইট-অর-ফ্লাইট" প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা শরীরকে বিপদ বা চাপ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত করে। এই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে শরীরের অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি অ্যাড্রেনালিন এবং করটিসল হরমোন নিঃসরণ করে। অ্যাড্রেনালিন হৃৎস্পন্দন বাড়ায়, রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, এবং ঘামগ্রন্থিগুলিকে সক্রিয় করে তোলে। এটি মূলত আমাদের হাতের তালু, পায়ের পাতা, এবং বগলে বেশি কার্যকর হয়, কারণ এই স্থানগুলিতে ঘামগ্রন্থি বেশি থাকে।এই কারণে, যখন আমরা স্ট্রেসে থাকি বা মানসিক চাপ অনুভব করি, তখন ঘাম বেশি হয়।
খাদ্য ও পানীয়
ক্যাফেইন, মশলাদার খাবার, এবং অ্যালকোহল অতিরিক্ত ঘামের জন্য দায়ী হতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস: বিশেষ করে এসএসআরআই (Selective Serotonin Reuptake Inhibitors) এবং এসএনআরআই (Serotonin-Norepinephrine Reuptake Inhibitors) ধরনের ওষুধগুলি, যেমন ফ্লুক্সেটিন, সেরট্রালিন, ভেনলাফ্যাক্সিন।অ্যান্টিসাইকোটিকস: কিছু অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ যেমন ক্লোজাপিন এবং কুয়েটিয়াপিন।বেদনানাশক ওষুধ: বিশেষ করে ওপিওয়েড শ্রেণীর ওষুধ যেমন মরফিন এবং কোডিন।
হরমোনাল থেরাপি: যেমন থাইরয়েড হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি এবং মেনোপজের জন্য হরমোন থেরাপি।
রক্তচাপের ওষুধ: কিছু উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ যেমন নেফিডিপিন।
স্টেরয়েডস: বিশেষ করে কোর্টিকোস্টেরয়েডস
অ্যান্টি-ডায়বেটিক ওষুধ: ইনসুলিন এবং ওরাল অ্যান্টি-ডায়াবেটিক ওষুধ বিশেষ করে যখন শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায় তখন অতিরিক্ত ঘাম হতে দেখা যায়।
অতিরিক্ত ঘাম দূর করার ঘরোয়া উপায়
- সঠিক পোষাক নির্বাচন: সুতি ও হালকা রঙের পোশাক পরিধান করুন।
- নিয়মিত গোসল: প্রতিদিন গোসল করলে ঘাম এবং দুর্গন্ধ কমে।
- মানসিক চাপ কমানো: যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, এবং অন্যান্য রিলাক্সেশন টেকনিক ব্যবহার করে মানসিক চাপ কমান।
- আপেল সিডার ভিনেগার: প্রতিদিন দুই চামচ আপেল সিডার ভিনেগার পান করলে অনেকের ঘাম কমতে দেখা যায়।
- বেকিং সোডা: বেকিং সোডা এবং পানি মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে ঘামে প্রবণ স্থানে লাগালে ঘাম কমে।
- নারকেল তেল: প্রতিদিন গোসলের পর শরীরে নারকেল তেল মাখলে ঘাম কম হয়।
- লেবুর রস: লেবুর রস এবং পানি মিশিয়ে শরীরে লাগালে ঘামের দুর্গন্ধ কম মনে হয়।
অতিরিক্ত ঘাম থেকে মুক্তির জন্য আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি
অতিরিক্ত ঘাম থেকে মুক্তির জন্য আধুনিক চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো ডাক্তারদের পরামর্শে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে করা উচিত।
অ্যান্টিপারস্পিরান্ট
ডাক্তারের পরামর্শে অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইডযুক্ত শক্তিশালী অ্যান্টিপারস্পিরান্ট ব্যবহার করা যায়, যা ঘাম গ্রন্থিকে বন্ধ করে দেয়।
আইওনটোফোরেসিস
এই পদ্ধতিতে হাত, পা বা বগলের ঘাম কমাতে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রয়োগ করা হয়। এটি ঘাম গ্রন্থির কার্যকলাপ কমাতে সাহায্য করে।
বোটক্স ইনজেকশন
বোটুলিনাম টক্সিন (বোটক্স) ইনজেকশন ঘাম গ্রন্থির স্নায়ু সংকেত বন্ধ করে দেয়। এটি সাধারণত বগলের অতিরিক্ত ঘাম কমাতে ব্যবহৃত হয় এবং প্রায় ৬ থেকে ১২ মাস কার্যকর থাকে।
মেডিসিন
ডাক্তারের পরামর্শে অ্যান্টি-কলিনার্জিক ওষুধ নেওয়া যেতে পারে, যা ঘাম উৎপাদন কমায়। তবে এই ওষুধগুলির কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, যেমন মুখে শুষ্কতা, দৃষ্টির সমস্যা ইত্যাদি।
মাইক্রোওয়েভ থেরাপি
মাইক্রোওয়েভ শক্তি ব্যবহার করে ঘাম গ্রন্থি ধ্বংস করা হয়। এটি সাধারণত বগলের ঘাম কমাতে ব্যবহার করা হয়।
লেজার থেরাপি
লেজার ব্যবহার করে ঘাম গ্রন্থি ধ্বংস করা হয়। এটি একটি স্থায়ী সমাধান হতে পারে, তবে এটি কিছুটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
সার্জারি
মানুষ তো আর সহজে সার্জারিতে যায় না।৷ তবে অত্যন্ত গুরুতর ক্ষেত্রে, যখন অন্যান্য পদ্ধতি কাজ করে না, তখন সার্জারি করা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এন্ডোস্কোপিক থোরাসিক সিম্পাথেটিকটমি (ETS) সার্জারি, যেখানে স্নায়ু কেটে দেওয়া হয় বা ব্লক করা হয় যা ঘাম উৎপাদনে ভূমিকা রাখে।
ঘামে দুর্গন্ধ হওয়ার কারণ
অতিরিক্ত ঘাম নিয়ে সমস্যা ছাড়াও কিছু মানুষের ঘামে খুব দুর্গন্ধ হয়। ঘামের এই দুর্গন্ধ নিয়ে অনেকে বিব্রতবোধ করে।ঘামে দুর্গন্ধ হওয়ার মূল কারণ হলো ব্যাকটেরিয়া। এছাড়া কিছু খাবার যেমন পেঁয়াজ, রসুন, মশলাদার খাবার, ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহলও ঘামের দুর্গন্ধ বাড়াতে পারে। হরমোনের পরিবর্তন যেমন মেনোপজ, পিউবার্টি, গর্ভাবস্থা ইত্যাদির সময় ঘামের পরিমাণ এবং গন্ধ পরিবর্তিত হতে দেখা যায়।
ঘামের দুর্গন্ধ দূর করার কিছু কার্যকর উপায় রয়েছে:
দৈনন্দিন অভ্যাস:
১. নিয়মিত গোসল: প্রতিদিন গোসল করে শরীর পরিষ্কার রাখুন। অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল সাবান ব্যবহার করতে পারেন।
২. শরীর ভালোভাবে মুছুন: গোসলের পর শরীর ভালোভাবে মুছুন যাতে আর্দ্রতা না থাকে।
৩. পরিষ্কার কাপড়: প্রতিদিন পরিষ্কার এবং শুষ্ক কাপড় পরুন। বিশেষ করে গরমের দিনে কটনের তৈরি হালকা কাপড় পরুন।
ডায়েট এবং খাদ্যাভ্যাস:
১. পানি পান: পর্যাপ্ত পানি পান করুন, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে।
২. মশলাদার খাবার পরিহার: ক্যাফেইন, মশলাদার খাবার এবং অ্যালকোহল কম পরিমাণে গ্রহণ করুন।
৩. সবজি এবং ফলমূল: সবজি এবং ফলমূল বেশি করে খান।প্রতিদিন কোন না কোন ফল খাওয়ার অভ্যাস করুন।
প্রাকৃতিক উপায়:
১. এলুম: এলুম পাউডার বা এলুম পাথর পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করুন।
২. বেকিং সোডা এবং কর্নস্টার্চ: এগুলো মিশিয়ে বগলে ব্যবহার করুন।
৩. লেবুর রস: লেবুর রস ঘামের স্থানে লাগান, এটি ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
অ্যান্টিপারস্পিরান্ট এবং ডিওডোরেন্ট:
১. ডিওডোরেন্ট: প্রতিদিন সকালে এবং প্রয়োজনে রাতে ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করুন। বাজারে অনেক ডিওডোরেন্ট পাওয়া যায। আপনি আপনার পছন্দমতো ব্যবহার করুন।
২. অ্যান্টিপারস্পিরান্ট: ঘুমানোর আগে অ্যান্টিপারস্পিরান্ট ব্যবহার করলে এটি ভালো কাজ করে। তবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
উপসংহার
অতিরিক্ত ঘাম অনেকের জন্য একটি বিব্রতকর সমস্যা হতে পারে, সাথে যদি ঘামে দুর্গন্ধ থাকে তাহলে সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে যায়। তবে সঠিক পদক্ষেপ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এর প্রতিকার করা সম্ভব।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন