মাথা ঘোরা | কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার | Healthylife
মাথা ঘোরার কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার![]() |
মাথা ঘোরা |
মাথা ঘোরা (Vertigo) একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। বেশিরভাগ মানুষের জীবনে কোন না কোন সময়ে মাথা ঘোরা বিষয়টি উপলব্ধি করে থাকেন। মাথা ঘোরা সাধারণত একটি অনুভূতি যেখানে সব কিছু ঘুরছে বা আপনার শরীরটি স্থিতিশীল নয় বলে মনে হয়। কখনও মনে হয় চারপাশ ঘুরছে, কখনও মনে হয় মাটি বা মেঝে অসমতল কখনও দাড়িয়ে থাকার ব্যালেন্স পাচ্ছেন না। এটি অনেকসময় গুরুতর হতে পারে এবং দৈনিক জীবনের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এই ব্লগ পোস্টে, আমরা মাথা ঘোরার কারণ, লক্ষন এবং প্রতিকারের উপর বিস্তারিত আলোচনা করব।
মাথা ঘোরার কারণ
মাথা ঘোরার অনেক কারণ রয়েছে । এখানে আমরা সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলি আলোচনা করব:
![]() |
অভ্যন্তরীণ কানের সমস্যা |
১. অভ্যন্তরীণ কানের সমস্যা:
অভ্যন্তরীণ কান আমাদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যখন অভ্যন্তরীণ কানে কোনো সমস্যা হয়, তখন মাথা ঘোরা হতে পারে।
- বিনাইন প্যারক্সিসমাল পজিশনাল ভার্টিগো (BPPV): এটি অভ্যন্তরীণ কানে ক্যালসিয়াম কণার অস্বাভাবিক গঠন থেকে ঘটে। রোগী যখন তার অবস্থান পরিবর্তন করেন তখনই মাথা ঘোরা শুরু করে। তারপর আস্তে আস্তে আবার কমে যায়। পরবর্তীতে আবার যখন অবস্থান পরিবর্তন করেন তখন আবারো মাথা ঘোরার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এধরনের মাথা ঘোরা সাধারণত বয়স্ক মানুষের মধ্যে দেখা যায়।
- মেনিয়েরস রোগ: এই অবস্থায় অভ্যন্তরীণ কানে তরলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং মাথা ঘোরা, কানের বাজনা এবং শুনতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। কানে ভো ভো আওয়াজের উপলব্ধি হয়। অ্যালার্জি, অস্বাভাবিক ইমিউন সিস্টেম প্রতিক্রিয়া, মাথায় আঘাত, মাইগ্রেনের মাথাব্যথা বা ভাইরাল সংক্রমণ সহ বিভিন্ন কারণে এটি হতে পারে।
- ভেস্টিবুলার নিউরোনাইটিস: এটি একটি ভাইরাল সংক্রমণ যা অভ্যন্তরীণ কানের ভেস্টিবুলার নার্ভকে প্রভাবিত করে।
২. মাইগ্রেন:
মাইগ্রেনের অনেক রুগী মাথা ব্যথার সাথে সাথে মাথা ঘোরার কথাও বলে। মাইগ্রেনের সাথে মাথা ব্যথা, আলো এবং শব্দে সংবেদনশীলতা এবং বমি বমি ভাব ছাড়াও অনেকের মাথা ঘোরে।
৩. নিম্ন রক্তচাপ:
রক্তচাপ হঠাৎ করে কমে গেলে মস্তিষ্কে রক্তের সরবরাহ কমে যেতে পারে, যা মাথা ঘোরা সৃষ্টি করতে পারে।
৪. চোখের সমস্যা:
দৃষ্টি সমস্যা বা চোখের মাংসপেশির সমস্যার কারণে মস্তিষ্কে সঠিক ভাবে তথ্য প্রেরণ না হলে মাথা ঘোরা হতে পারে।
৫. অর্থোস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন
হঠাৎ করে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় মাথা ঘোরা হতে পারে, যা 'অর্থোস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন' নামে পরিচিত।
৬. ডিহাইড্রেশন:
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি না পান করলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে, যার ফলে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, ক্লান্তি, শুষ্ক মুখ, মূত্রের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং গাঢ় রঙের মূত্রের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
৭. রক্তে শর্করার পরিমাণের তারতম্য:
ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার হঠাৎ পরিবর্তন মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে। এর সাথে ক্লান্তি, ক্ষুধা বৃদ্ধি বা হ্রাস, ঘন ঘন মূত্রত্যাগ এবং ঝাপসা দৃষ্টির মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে।
৮. হৃদরোগ:
করোনারি ধমনী রোগ, হৃদপেশীর দুর্বলতা এবং অ্যারিথমিয়া (অনিয়মিত হৃদস্পন্দন) এর মতো হৃদরোগের বিভিন্ন অবস্থা মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে।
৯. স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা:
স্ট্রোক, ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক (TIA), মাইগ্রেন এবং মস্তিষ্কের টিউমারের মতো স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে।
১০. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা, মাথাব্যথা এবং দেখা দিতে পারে। যেমন, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, ব্যথানাশক এবং কিছু অ্যান্টিবায়োটিক মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে।
মাথা ঘোরার লক্ষণ
মাথা ঘোরার সাথে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
ভারসাম্যহীনতা বা অস্থিরতা অনুভব করা: এটি মাথা ঘোরার সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ।
ঘুরতে থাকা বা ঘোরার অনুভূতি: মনে হতে পারে যে আপনার চারপাশের জিনিসপত্র ঘুরছে বা আপনি নিজেই ঘুরছেন।
হালকা মাথা: এটি এমন অনুভূতি হতে পারে যেন আপনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন।
বমি বমি ভাব বা বমি: মাথা ঘোরার সাথে বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
চোখে অন্ধকার দেখা: মাথা ঘোরার সময় কিছুক্ষণের জন্য চোখে অন্ধকার দেখা যেতে পারে।
দুর্বলতা বা ক্লান্তি: মাথা ঘোরার কারণে দুর্বলতা বা ক্লান্তি অনুভব হতে পারে।
মাথাব্যথা: মাথা ঘোরার সাথে মাথাব্যথা হতে পারে।
কানে বাজানো বা শো শো করার সমস্যা: অন্তঃকর্ণের সমস্যার কারণে মাথা ঘোরার সাথে কানে বাজানো বা শো শো করার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
চেতনা হারানো: কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে, মাথা ঘোরার কারণে চেতনা হারাতে পারে।
মাথা ঘোরার প্রতিকার
মাথা ঘোরা নিরাময়ের জন্য কিছু সাধারণ প্রতিকার এবং চিকিৎসা পদ্ধতি হল:
১. ঔষধ:
যদি মাথা ঘোরা মাইগ্রেন, মেনিয়েরস রোগ বা অন্যান্য কানের সমস্যার কারণে হয়, তবে ডাক্তার নির্দিষ্ট ঔষধ নির্ধারণ করে চিকিৎসা দিবেন। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, মাথায় টিউমার ইত্যাদি রোগের কারনে যদি মাথা ঘোরে তাহলে ডাক্তার সেই অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করবেন।
২. শারীরিক থেরাপি:
- ভেস্টিবুলার রিহ্যাবিলিটেশন: এটি একটি বিশেষ শারীরিক থেরাপি যা মস্তিষ্ককে কানের সমস্যা থেকে আসা সংকেতগুলি পুনর্বাসনের জন্য সাহায্য করে।
- ব্র্যান্ড-ডারফ ম্যানুভার: এই ম্যানুভারটি BPPV এর জন্য কার্যকরী হতে পারে, যা মাথা ঘোরা কমাতে সাহায্য করে।
৩. জীবনধারায় পরিবর্তন:
- হাইড্রেশন: পর্যাপ্ত পানি পান করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ডিহাইড্রেশন মাথা ঘোরা বাড়াতে পারে।
- সুষম খাদ্য গ্রহণ: ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম: পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন: নিয়মিত ব্যায়াম করলে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয় এবং মাথা ঘোরা রোধে সাহায্য করে।
- ধূমপান এবং মদ্যপান ত্যাগ করুন: ধূমপান এবং মদ্যপান রক্ত চাপে সমস্যা করে এবং মাথা ঘোরা বাড়াতে পারে।
৪. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকুন:
আপনি যদি কোনও ওষুধ গ্রহণ করেন, তাহলে সেগুলির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং যদি কোন ওষুধ সেবনের পর মাথা ঘোরে তবে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
৫. বাসায় কিছু সহজ পদক্ষেপ:
- হঠাৎ করে শরীরের অবস্থান পরিবর্তন না করা।
- মাথা ঘোরার সময় সোজা হয়ে বসে থাকা।
- চোখ বন্ধ করে এবং একটি স্থির বস্তুতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
যদি আপনার মাথা ঘোরা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা মাথা ঘোরার সাথে সাথে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা দেয় তবে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তার দেখাবেন।
- তীব্র মাথাব্যথা
- বুকের ব্যথা
- শ্বাসকষ্ট
- হাত বা পায়ের দুর্বলতা
- কথা বলার অসুবিধা
- অজ্ঞান হওয়া
পরিশেষে
মাথা ঘোরা এমন একটি সমস্যা যা অনেক কারণ থেকে সৃষ্টি হতে পারে এবং প্রতিটি ব্যক্তির জন্য কারনও বিভিন্ন রকম হতে পারে। উপরের তথ্যগুলি আপনার জন্য সহায়ক হতে পারে, তবে কারন অনুসন্ধানে বা মাথা ঘোরা উপশমে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ।
Thank you from-
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন