ফ্যাটি লিভার: কারণ, লক্ষণ, এবং প্রতিকারের সম্পূর্ণ গাইড
ফ্যাটি লিভার কি?
ফ্যাটি লিভার হল লিভারে বা যকৃতে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়া। এটি সাধারণত যকৃতের মোট ওজনের ৫-১০ শতাংশ চর্বি দ্বারা পূর্ণ হলে ফ্যাটি লিভার বলা হয়। ফ্যাটি লিভার দুই ধরনের হয়, অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার এবং নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার। অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হয়, যেখানে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার সাধারণত মদ্যপান ছাড়াও বিভিন্ন কারণের কারণে হতে পারে। আমাদের বাংলাদেশে যেহেতু খুব কম মানুষ মদ্যপান করে তাই নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার বেশি দেখা যায।
ফ্যাটি লিভার কেন হয়?
ফ্যাটি লিভার হ4ওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেমন:
১. অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন মানে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি। এই অতিরিক্ত চর্বি লিভার বা যকৃতে চর্বি জমার কারণ হতে পারে।
২. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: বেশি চর্বি ও চিনিযুক্ত খাবার খেলে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমবে। এই চর্বি জমা যকৃতের উপরও প্রভাব ফেলে।
৩. ডায়বেটিস: টাইপ ২ ডায়বেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফ্যাটি লিভার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যদি তাদের ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকে।
৪. উচ্চ কোলেস্টেরল: উচ্চমাত্রার লিপিড বা কোলেস্টেরল যকৃতে চর্বি জমার একটি কারণ। আপনার লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করে বেশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেতে শুরু করুন। তা না হলে আপনি ফ্যাটি লিভারে ভুগতে পারেন।
৫. অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন: আপনি যদি অতিরিক্ত মদ পান করে থাকেন তবে সাবধান হয়ে যান। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার হয়ে থাকে।
৬. জেনেটিক ফ্যাক্টর: আপনি মদ পান করেন না, আপনার ওজনও ঠিক আছে তারপরেও ফ্যাটি লিভার! পরিবারের ইতিহাসে যদি ফ্যাটি লিভার থাকে, তাহলে সেই ঝুঁকি আপনার ফ্যাটি লিভারের কারন হতে পারে।
ফ্যাটি লিভার রোগের লক্ষণ
ফ্যাটি লিভার সাধারণত প্রাথমিক অবস্থায় কোনো লক্ষণ প্রকাশ করে না। তবে পরিস্থিতির অবনতি হলে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে:
১. অস্বস্তি বা ব্যথা: পেটের উপরের ডান দিকে ব্যথা বা অস্বস্তি।
২. অবসাদ: শারীরিক দুর্বলতা ও অবসাদ দেখা দিতে পারে।
৩. ওজন হ্রাস: অপ্রত্যাশিত ওজন হ্রাস। কোন কারন ছাড়াই ওজন কমতে শুরু করে।
৪. বমি বমি ভাব: বমি বা বমি বমি ভাব হতে পারে। পেট ভরা ভরা অনূভুতি হতে পারে।
৫. বদহজম: খাবার সহ্য না হওয়া বা ঘন ঘন বদহজম দেখা দিতে পারে।
ফ্যাটি লিভার টেস্ট
ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়, যেমন:
১. রক্ত পরীক্ষা: লিভার এনজাইম লেভেল চেক করার জন্য।
২. ইমেজিং পরীক্ষা: আলট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান বা এমআরআই দ্বারা যকৃতের অবস্থা, আকৃতি পরীক্ষা।
৩. বায়োপসি: যকৃতের টিস্যু নিয়ে ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায়।
ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায়
ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তি পেতে কিছু উপায় রয়েছে:
১. ওজন কমানো: স্বাস্থ্যকর ডায়েট ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন কমানো।
২. শারীরিক কার্যকলাপ: নিয়মিত ব্যায়াম করুন ও ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি বাড়িয়ে দিন।
৩. সঠিক খাদ্যাভ্যাস: স্বাস্থ্যকর, সুষম খাবার খান। চর্বিযুক্ত খাবার কম খাবেন।
৪. অ্যালকোহল এড়ানো: মদ্যপান থেকে বিরত থাকা। কম নয়, ফ্যাটি লিভার হয়ে থাকলে সম্পুর্নভাবে অ্যালকোহল নিষেধ।
৫. ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ: রক্তের গ্লুকোজ লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৬. চিকিৎসকের পরামর্শ: নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে যকৃতের পরীক্ষা করা ও চিকিৎসকের পরামর্শে চলা।
ফ্যাটি লিভারের খাদ্য তালিকা
ফ্যাটি লিভার রোগীদের জন্য কিছু খাবারের তালিকা:
ফাইবার যুক্ত খাবার: ওটস, ব্রাউন রাইস, হোল গ্রেইন আটা ইত্যাদি।
সবুজ শাকসবজি: পালংশাক, ব্রকলি, শালগম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সবুজ মটরশুটি ইত্যাদি।
ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার: টুনা, সার্ডিন, স্যামন, কাঠবাদাম, ওয়ালনাট, ফ্ল্যাক্সসিড, অলিভ ওয়েল
বিচি–জাতীয় খাবার: শিমের বিচি, সূর্যমুখীর বিচি, কুমড়ার বিচি, রেড কিডনি বিনস
দুগ্ধজাত খাবার: দই, মাঠা
ফ্যাটি লিভার হলে কি খাওয়া উচিত নয়?
ফ্যাটি লিভার হলে কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত:
১. অতিরিক্ত চর্বি যুক্ত খাবার: ভাজা খাবার, ফাস্ট ফুড।
২. মিষ্টি ও চিনিযুক্ত খাবার: ক্যান্ডি, পেস্ট্রি, সোডা, আইসক্রিম, চকলেট, কোমল পানীয়, বেকারির খাবার।
৩. অ্যালকোহল: যেকোনো ধরনের মদ্যপান সম্পুর্ণ নিষেধ।
৪. রেড মিট: বেশি চর্বিযুক্ত মাংস ( গরু, খাসির মাংস)
ফ্যাটি লিভার কমানোর ব্যায়াম
শুধু খাবারে সতর্কতা অবলম্বন করলে হবে না সাথে ব্যায়াম করতে হবে। ফ্যাটি লিভার কমানোর জন্য কিছু কার্যকর ব্যায়াম:
১. কার্ডিও ব্যায়াম: জগিং, হাঁটা, সাইক্লিং, দড়ি লাফ
২ ওয়েট ট্রেনিং: লিফটিং ওয়েটস বা রেজিস্টেন্স ব্যান্ড ব্যবহার।
৩. ইয়োগা: নিয়মিত ইয়োগা অভ্যাস। কপালভাতি প্রাণায়াম ফ্যাটি লিভারে খুব উপকারী।
৪. স্ট্রেচিং: শরীরের নমনীয়তা বৃদ্ধির জন্য।
ফ্যাটি লিভার গ্রেড ১ মানে কি?
ফ্যাটি লিভার সাধারণত তিনটি গ্রেডে বিভক্ত করা হয়: গ্রেড ১ (মাইল্ড), গ্রেড ২ (মোডারেট), এবং গ্রেড ৩ (সিভিয়ার)। এই তিনটি গ্রেড যকৃতের চর্বি জমার মাত্রা ও তার প্রভাবকে বোঝায়। ফ্যাটি লিভার গ্রেড ১ হল ফ্যাটি লিভারের প্রাথমিক পর্যায় যেখানে যকৃতে সামান্য চর্বি জমা হয়। এটি সাধারণত খুবই সাধারণ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করা গেলে এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তবে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রেড ৩ কে শেষ ধাপ হিসেবে ধরা হয়, কারণ এটি সবচেয়ে গুরুতর এবং এতে যকৃতের কার্যক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়।
উপসংহার
ফ্যাটি লিভার রোগের শেষ ধাপে লিভার সিরোসিস হতে পারে। এই সিরোসিস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রাথমিক অবস্থায় ফ্যাটি লিভার নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক জীবনধারা ও চিকিৎসা অনুসরণ করে যকৃতের স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন